শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
শ্রমিকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০৪৪ কোটি টাকা পাচার

শ্রমিকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০৪৪ কোটি টাকা পাচার

স্বদেশ ডেস্ক ॥ সুপারভাইজার পদে মিরর ডেভেলপমেন্ট নামে একটি ল্যান্ড ডেভেলপিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন খোরশেদ আলম। ২০ হাজার টাকা বেতনের বিপরীতে তার দায়িত্ব ছিল প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবন দেখভাল করা। সীমিত বেতনের টাকায় কোনোরকমে চলত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এ স্থায়ী বাসিন্দার সংসার।
অথচ এ খোরশেদের নামেই এমন একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যে অ্যাকাউন্ট থেকে গত তিন বছরে এলসির মাধ্যমে আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকার পণ্য। এটি কাগুজে তথ্য। বাস্তবতা হচ্ছে, পণ্য আমদানির মোড়কে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কার্যত চীন, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে পাচার হয়ে গেছে। অথচ যার অ্যাকাউন্ট থেকে এ কাজ করা হয়েছে সেই খোরশেদের ভাষ্য, তিনি এসবের কিছুই জানেন না।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন বিস্ময়কর অর্থপাচার কা-। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের তদন্ত শাখা সিআইডিও এ নিয়ে তদন্ত করছে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের তদন্তকারী এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন কমিশন থেকে সংগ্রহ করা খোরশেদ আলমের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রামের ব্যাপারী বাড়ি। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এলসি
খোলাসহ পুরো আমদানি প্রক্রিয়ায় খোরশেদ আলমের জাতীয় পরিচয়পত্রের যে ফটোকপি ব্যবহৃত, তাতে ঘষামাজা করে বসানো হয়েছে অন্য একজন ব্যক্তির ছবি ও স্বাক্ষর। তদন্তকারী সূত্র বলছে, একটি ব্যাংকের রাজধানীর নয়াপল্টন ও শান্তিনগরের দুটি শাখায় হিসাব খোলার পর ওই ব্যাংকের মাধ্যমেই এলসি করে কনটেইনার আমদানি হয় খোরশেদ আলমের নামে। তবে তাকে নজরদারিতে রেখে ওই ব্যাংকে জমা দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংকের পরিচিতিদানকারীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রমাণিত হয় ট্রেড লাইসেন্স ভুয়া, একইভাবে খোরশেদের জাতীয় পরিচয়পত্রে ঘষামাজা করে অন্যজনের ছবি যুক্ত করা হয়েছে। তবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পরিচিতিদানকারী ব্যক্তি মিরর ডেভেলপমেন্টের মালিক দিদারুল আলম টিটু ও তার বন্ধু শহীদুল আলম। আর খোরশেদের ভোটার আইডিতে ছবি বসানো ব্যক্তিটি দিদারুল আলমের আরেক বন্ধু আবদুল মোতালেব। রাজধানীর খিলক্ষেতে ডুমনি ইউনিয়নের পতিরা গ্রামের মো. নুরু মিয়ার ছেলে এই আবদুুল মোতালেব। আবদুল মোতালেবের ছবি দেখে তার ভাই আবু তালেব নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ব্যবসার উদ্দেশ্যে চীন গেছেন আবদুল মোতালেব। তার মোবাইল নম্বর নেই।
তা হলে কীভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও এলসি খোলা হলো? এলসির সরেজমিন প্রতিবেদনে নয়াপল্টন শাখার ওই ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মেহেদি হোসেন বলেন, হেনান আনহুই এগ্রো এবং এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি প্রতিষ্ঠান দুটিতে সরেজমিনে গিয়ে চারদিকে দেয়াল বেষ্টিত একটি করে টিনশেড ঘর দেখতে পান। মালিক খোরশেদ আলম ফ্যাক্টরির ভেতরে ছিলেন। সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদি হোসেন বলেন, সরেজমিন প্রতিবেদন সবই মিথ্যা। প্ররোচনা করে ম্যানেজার তাকে দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করিয়ে স্বাক্ষর নিয়েছেন। আমি এখন রাজসাক্ষী হতে রাজি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে উঠে আসে, খোরশেদ আলমের নামে ব্যাংক-এলসি অ্যাকাউন্ট খোলা ও এ সময়ে জাল দলিলাদি সরবরাহে দিদারুল আলম টিটু, তার দুই বন্ধু শহীদুল আলম এবং আবদুল মোতালেব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত। তারাও কোনো না কোনোভাবে এ অপকর্মের সুবিধাভোগী। তবে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে মিরর ডেভেলপমেন্টের মালিক দিদারুল আলম টিটুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া বিদেশ থেকে জাহাজে করে পণ্যভর্তি কনটেইনার আমদানিতে চট্টগ্রাম বন্দরে যে কয়টি ধাপ পার করতে হয় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তার সবকটিতেই অতিক্রম করে কথিত ‘হেনান আনহুই এগ্রো এবং এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি’। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী-কর্মকর্তারাও জড়িত বলে মনে করছে তদন্তকারীরা।
পণ্যবাহী কনটেইনার খালাসে বন্দর কর্তৃপক্ষের স্ক্যানিং, এআইআর, গেট শাখা, নিরাপত্তা বিভাগ, ট্রাফিক বিভাগ, স্টাফ শাখায় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু হেনান ও এগ্রো বিডির ৯০টি কনটেইনার খালাসের ব্যাপারে গেট শাখা বলেছে, প্রতিটি পণ্যচালান অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ ও আউটপাস গেটে রক্ষিত অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সঙ্গে মিলিয়ে এন্ট্রি নিশ্চিতের পর খালাস দেওয়া হয়। অন-চেসিস কনটেইনার ডেলিভারির আগে স্ক্যানিং গেটে কর্মরত কর্মকর্তার স্বাক্ষরকৃত প্রতিবেদনের হার্ডকপি, এসজিএসের পাঠানো মেইল যাচাই, এআইআরের ছাড়পত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। এ পণ্য ছাড়ে স্ক্যানিং প্রতিবেদনসহ অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চের (এআইআর) অ্যাসেসমেন্ট নোটিশে ছাড়পত্র পেয়েই তারা পণ্য খালাসে অনুমতি দেয়।
তবে স্ক্যানিং শাখা বলছে, তারা কিছইু জানে না। আবার বেসরকারি স্ক্যানিং প্রতিষ্ঠান এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেড জানায়, কনটেইনারগুলো স্ক্যানে একবারের জন্যও তাদের কাছে কেউ আসেনি। তাদের নামে যে স্ক্যান কপি বা তাদের স্বাক্ষরসংবলিত যে ডকুমেন্টস পাঠানো হয়েছে, সেগুলোও জাল।
অন্যদিকে বিল অব এন্ট্রি, স্ক্যানিং রিপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র দেখে ছাড়পত্র প্রদানকারী এআইআর শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সুমন আল মাসউদ অনুসন্ধানী কর্মকর্তাদের বলেন, কনটেইনারগুলো ছাড়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তাদের কাছে না আসায় তারা পণ্য ছাড়ের অনুমতিই দেননি। হয়তো সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধি সুকৌশলে কোনো সুবিধাজনক মাধ্যমে (অন্য কোনো অফিসারকে দিয়ে) অথবা স্বাক্ষর জাল করেও নিতে পারে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বিভাগের ভাষ্য, কনটেইনার খালাস দেওয়ার আগে কাস্টমস এআইআর এবং গেট ডিভিশনের যাচাই নম্বর দেখে ছাড় দেওয়া হয়। তবে নিরাপত্তা বিভাগ এসব নোটিশ সংরক্ষণ করে না। আবার ট্রাফিক বিভাগ বলছে, কনটেইনার খালাসের জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাখিলকৃত যাবতীয় কাগজপত্র সঠিক ছিল। স্টাফ শাখার বক্তব্য, বিল অব এন্ট্রির কাগজপত্রে সন্দেহ হয়নি। বন্দরের এ কয়টি শাখা ছাড়াও শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স নিয়ে প্রতিটি জায়গায় পণ্য খালাসে দুই রকমের তথ্য।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শহীদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এটি একটি ভয়াবহ জালিয়াত ও অর্থপাচার চক্র। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীকে সামনে রেখে এ চক্র বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) লাইসেন্স, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের ট্রেড লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপের নথিপত্র ও তথ্যাদি জালিয়াতি করে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। চক্রের বাইরে আর কে কে কীভাবে জড়িত, তাও আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ক্ষেত্রে দুদক ও সিআইডির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মেসার্স এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি এবং মেসার্স হেনান আনহুই এগ্রো এলসি নামে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ১৭টি চালানে ৯০টি কনটেইনার আসে খোরশেদ আলমের নামে। আমদানির কাগজপত্রে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা রাজধানীর কেরানীগঞ্জ আবদুুল্লাহপুরের চরজাগালিয়া ও খিলক্ষেতের ডুমনিতে। আর আমদানিকৃত পণ্যের হিসাবে নতুন উৎপাদনশীল কারখানার মেশিনারিজের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে ঠিকানাগুলোয় ওই দুই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই। এমনকি গত তিন বছরে ১৫টি এলসির মাধ্যমে ৭৮টি কনটেইনার ভরে মিথ্যা ঘোষণায় বৈধ/অবৈধ কী ধরনের পণ্য এসেছে, তা কোথায় পাঠানো হয়েছেÑ সেই হিসাবও নেই কারও কাছে।
বিনা বাধায় এতগুলো চালান খালাসের পর ২০১৭ সালের ৫ ও ৬ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে খোরশেদের নামে আমদানি করা দুটি এলসিতে ১২টি কনটেইনার সন্দেহজনকভাবে আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। ধরা পড়ে মেশিনারিজের চেয়ে কম দামি নি¤œমানের মদ, সিগারেট, টেলিভিশন আমদানির চিত্র। ইনভেন্টি করে প্রতিটি কনটেইনারের আড়ালে ১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পাচারের হিসাব ধরে শুল্ক গোয়েন্দা। সে হিসাবে ওই ১২টি কনটেইনার আমদানির নামে ১৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এর পর এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি এবং হেনান আনহুই এগ্রো নামক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরিদর্শন, মালিক খোরশেদ আলমের নাম খুঁজতে গিয়ে অর্থপাচারের এ কৌশল সম্পর্কিত সূত্র হাতে আসে অনুসন্ধানী কর্মকর্তাদের। সুপারভাইজার খোরশেদ আলমের নামে মেসার্স এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপির বিপরীতে ২০১৬ ও ১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে ৯টি এলসিতে ৪৬টি কনটেইনারে পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থপাচার হয় ৫৩৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর হেনান আনহুই এগ্রোর নামে ২০১৬ ও ১৭ সালে ৬টি এলসির মাধ্যমে ৩২টি কনটেইনারের আড়ালে পাচার হয় ৩৭১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর মোট ৯০টি কনটেইনারের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। কিন্তু যার নামে এতগুলো কনটেইনার আমদানি ও অর্থপাচারের অভিযোগ, তিনি শুনে রীতিমতো অবাক।
নিজেকে নির্দোষ দাবিদার খোরশেদ আলমের ভাষ্য, ১৯৮৫-২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ডেমরা জুটমিলে কাজ করেছেন। ২০০৩-২০১৪ সাল পর্যন্ত বাবার সঙ্গে এলাকায় কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। এর পর ২০০৪-২০১৬ সাল পর্যন্ত মিরর ডেভেলপমেন্টে ভবন দেখভালের কর্মচারী বা সুপারভাইজার পদে চাকরি করেছেন। আর চাকরির আবেদনে মিরর ডেভেলপমেন্টের মালিক দিদারুল আলম টিটুর কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা দেন তিনি। হয়তো তার নাম ব্যবহার করেই দিদারুল আলম টিটু জালিয়াতি করে কাগজপত্র তৈরিসহ তার নামে বিদেশে অর্থপাচার করেছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ার কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন খোরশেদ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877